সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৬

৭১ সালের বাংলাদেশ-ভারত গোপন গোলামি চুক্তির কিছু গোপন কথা-১

'৭১ সালের বাংলাদেশ-ভারত গোপন গোলামি চুক্তির কিছু গোপন কথা-১



লিখেছেনঃ আদিল মাহমুদ (তারিখঃ বৃহঃ, ১০/১১/২০১১ - ১৯:১৩)

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বেশ কিছু গুজব ডালপালা সহকারে জন্ম নিয়েছিল যার জের আজ ৪০ বছর পরেও চলছে। ধর্মবিশ্বাসের মতই এসব গুজবের শক্তিমত্তা। সব গুজব যে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিই প্রসব করেছে তা নয়। স্বাধীনতার পক্ষের অনেকেও নানান কারনে এসব গুজবের পরিষ্ফুটন ও প্রচারে সক্রিয় ও কখনোবা অগোচরে সাহায্য করেছেন।

যেমন কর্নেল তাহের বীর উত্তম পর্যন্ত পর্যন্ত এই গোপন চুক্তির কথা সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ পত্রে উল্লেখ করেছেন। ডকুমেন্ট আকারে এই ধরনের সূত্র থেকে এসবের সন্ধান পেলে তো ছাগু বা ছূপা ছাগুদের আর কথাই নাই। এর মধ্যে অন্যতম একটি ন্যক্কারজনক গুজব নিয়ে কিছুদিন আগে আমাদের প্রিয় আবু তাহের ভাই হাজির হয়েছিলেন। সেটি হল মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে সম্পাদিত এক তথাকথিত গোপন চুক্তি যার বদৌলতে নাকি ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই তথাকথিত গোপন চুক্তি তাহের ভাই এবং সমমনাদের কাছে গোলামি চুক্তি নামে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কারন এই চুক্তির ধারাগুলি দেখলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী যে কোন বাংগালীরই খারাপ লাগবে। মনে হবে, হায় হায়, কি ন্যাক্কারজনক চুক্তিই না সে সময়কার সরকার করেছিল। ভারতের কাছে দাসখত লেখা আর কাকে বলে। এখন বাস্তব ভিত্তিক কিছু সূত্র ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনা করা যাক সেই গোপন গোলামি চুক্তি। আবু তাহের গং মানুষ হবে এমন দূরাশা আমি আর করি না, তবে অন্তত যাতে কেউ মিছে হীনমন্যতায় না ভোগেন তার জন্য এই রচনা।


মাসুদুল হক সাহেব তার র‌চিত "বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র ও সিআইএ এর ভূমিকা" গ্রন্থে এই চুক্তির ব্যাপারে নাতিদীর্ঘ এনালাইসিস রচনা করেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে কোন রকম বাস্তবতার ধার না ধরেই। উল্লেখিত গোপন চুক্তির ধারা সমেত তার জ্ঞানগর্ভ এনালাইসিস ব্লগার বাউল তাহেরের পোষ্ট থেকে কষ্ট করে টাইপ করেছেন, এখানে তা দেখতে পারেন। আবু তাহেরের প্রথম পোষ্ট এখানে আছে। ডিসেম্বর মাস আসছে, আশা করা যায় যে তাহের ভাই এর সমমনা ভাই ব্রাদাররা আবারো সহি সূত্র সমেত এই গোপন চুক্তি ফাঁস করা শুরু করবেন।


সবাই জানেন যে যে কোন সরকারী দলিল, এমনকি সাধারন চিঠিপত্রও রেফারেন্সিং এর জন্য স্মারক নম্বর সহকারে থাকে। সে নিয়ম ’৭১ সালে মুজিব নগর সরকারের প্রাত্যাহিক কাজকর্মেও পালিত হত, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সরকারী প্যাডেই সিল মোহর, স্মারক নম্বরসহই এসব কাজের রেকর্ড রাখা হত। অন্য কোন দেশের সাথে যে কোন চিঠিপত্র বিনিময়ও তার বাইরে নয়, আর লিখিত আকারে কোন চুক্তি হলে তো কথাই নেই। সে চুক্তি নিঃসন্দেহে যথাযথ কিছু নিয়ম মেনেই করা হবে, অন্তত সে চুক্তির কপি থাকতে হবে দুই দেশের কাছেই। এই কথিত গোপন চুক্তির কোন অফিশিয়াল কপি দুই দেশের কোন অফিশিয়াল সূত্র থেকেই বের হয়নি। এর কারন কি? এই চুক্তি ফাঁস করনে ওয়ালাদের দাবী; মুজিব দেশে ফিরে সেই গোলামি চুক্তি দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে চুক্তি বাতিল করে দেন (এর কারন সম্ভবত এই তথাকথিত গোপন চুক্তির বেশীরভাগ ধারাই কার্যক্ষেত্রে কেন দেখা যায়নি তা ব্যাখ্যা করা)। লিখিত আকারে কোন চুক্তি থাকলে তা কিভাবে মুখের এক কথায় বাতিল করা যায়? চুক্তি মানেই যে সব সময় শর্ত পালিত হয় তা না, তবে অন্তত কোন পক্ষ শর্ত পালন না করলে অপর পক্ষ আপত্তি করে, সে নিয়ে নানান দেন দরবার হয়। সে বাতিল ঘোষনার সূত্র কই? ভারত বাংলাদেশের ভয়ে একেবারে বিনা আপত্তিতে মেনি বেড়ালের মত বাতিল মেনে নিল? আরো মজার ব্যাপার হল যে ভারতকে ধমকে চুক্তি বাতিল করানোর পর আবার সেই ভারতই কিভাবে যেন পরের মাসেই ধমক দেওয়া বংগবন্ধুর সাথে সুড়সুড় করে বসে ২৫ বছর মেয়াদী দীর্ঘ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে বসল। এটা কোনদিন সম্ভব মনে হয়? মনে হয় মার্চ মাসে বংগবন্ধু আরেক কড়া ধমক দিয়েছিলেন। আজ পর্যন্ত এই চুক্তির কোন অফিশিয়াল কপি না দেখা গেলেও (এমনকি ভারতের পক্ষ থেকে কেউ আজ পর্যন্ত এই চুক্তির নামও নেয়নি, পরে ততকালীন একজন শীর্ষ ভারতীয় কর্মকর্তার ভাষ্য দেখব) এর সূত্র মনে হয় ৭১ সালে দিল্লীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধূরীকে কোট করে জনৈক মাসুদুল হক নামের একজন সাংবাদিকের। মাসুদুল হকের দাবী অনুযায়ী ’৮৯ সালে তাকে শামসুল হুদা চৌধূরী নাকি এক একান্ত সাক্ষাতকারে এই চুক্তি ফাঁস করেন। মুজিব নগর সরকারের বিশেষ দূত মোহাম্মদ নুরুল কাদেরের লিখিত “দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা” বইকে এই চুক্তির আরেক সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। খুবই শক্তিশালী সূত্র মনে হলেও এর একটি কথাও নুরুল কাদের সাহেবের নিজের না, উনি এই চুক্তির পুরোটাই মাসুদুল হকের বই রেফার করেছেন। উনি আসলে চুক্তির উল্লেখিত সময়ে মুজিব নগরের ধারে কাছে এমনকি ভারতেও ছিলেন না। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন ৪ঠা অক্টোবর।


এই জাতীয় চুক্তির সন্ধান এবং এনালাইসিস পেলে আবু তাহের গংদের আর পায় কে। মাসুদুল হল সাহেবের এনালাইসিস পড়লে যা বোঝা যায় তা হল এই যে ৭১ সালের প্রবাসী মুজিব নগর সরকার ভারতের কাছে এক মহা দাস খত লিখে দিয়েছিল, এমনই ভয়াবহ সেসব ধারা যে চুক্তি স্বাক্ষর করতে গিয়ে সৈয়দ নজরুল সাহেব নাকি মূর্চ্ছা যান। সেসব ভয়াবহ গোলামি চুক্তির ধারা থেকে বংগবন্ধু আসমান থেকে নাজিল হওয়া সুপারম্যানের মত আবির্ভূত হয়ে জাতিকে রক্ষা করেন, নয়ত বাংলাদেশ ভারতের অংগরাজ্যে পরিনত হয়ে যাচ্ছিল। খেয়াল রাখতে হবে যে এমন উদার বংগবন্ধু বন্দনা অনেককে খুশী করলেও এই ধরনের এনালাইসিসের মূল কারন হল ১৬ই ডিসেম্বরে প্রাপ্ত স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা, বংগবন্ধুর ঘাড়ে বন্দুক রেখে আসলে স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা হয়েছে। এভাবে কৌশলে বংগবন্ধু ভক্তদেরও না চটিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করার কৌশলের প্রসংশা করতেই হয়। “১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ বাংলাদেশ পাকিস্থান সৈন্য মুক্ত হয় মাত্র কিন্তু স্বাধীন, সার্বভৌম হয় ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী-যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্থানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকা আসেন।“


প্রথমে দেখা যাক এমন চুক্তির ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত ততকালীন বাংলাদেশ সরকারের অফিশিয়াল সূত্রগুলি কি বলে। পরের পর্বে সেই গোলামি চুক্তির কিছু গোলামি শর্তের তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষন করা হবে। ’৭১ সালে ভারতের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন অনেকে যেমন ভাবেন পূর্বপরিকল্পিত বাস্তব মোটেও তেমন বলে না। ভারত জুন জুলাই মাস পর্যন্তও পুরো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি ঠিক কি ভাবে এবং কি মাত্রায় আমাদের সাহায্য করবে। মানবিকতার খাতিরে আমাদের সাহায্য সহযোগিতা দিচ্ছিল ঠিকই তবে পাকিস্তানের সাথে সরাসরি কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে তাদের মোটেও ছিল না, যদিও ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সে মানসিক প্রস্তুতি তাদের নিতে হচ্ছিল। ভারতীয় রাজনীতির ডানপন্থী শক্তিও চাচ্ছিল না পাকিস্তানের সাথে সরাসরি কোন সঙ্ঘাতে জড়াতে। ফলে প্রথম দিকে ভারতের প্রদত্ত সামরিক সহায়তা ছিল অনেক সীমিত। এ কারনে জুন মাসের দিকে মুজিব নগর সরকারের ভেতরেও দেখা দেয় চরম হতাশা, তাজউদ্দিনের প্রধানমন্ত্রীত্বও দলের মধ্য থেকেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। অবশেষে আগষ্ট মাসে সোভিয়েত রাশিয়া ভারতের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হলে ভারতীয় দৃষ্টিভংগীতে দ্রুত পরিবর্তন দেখা দেয়। ঝিমিয়ে পড়া বাংলাদেশ শিবির চাংগা হয়ে ওঠে। সম্ভাবনা দেখা দেয় বাংলাদেশ ভারত সম্মিলিত বাহিনী গঠনের। সেপ্টেম্বর মাসে ইন্দিরার বাংলাদেশ বিষয়ক উপদেষ্টা ডিপি ধর ও তাজউদ্দিনের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনার বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনাও হয়। এই চুক্তি গোপন রাখার কারন ছিল এই যে এই চুক্তি সম্পাদনার মানে হল ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া, যা সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের পক্ষে করা সম্ভব ছিল না নানান কূটনৈতিক কারনে। এমনকি সোভিয়েত রাশিয়া ভারতের সাথে মৈত্রী চুক্তি করলেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে তাদের তখনো আপত্তি ছিল। এরপর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মইদুল হাসান ডিপি ধরের সাথে এই বিষয়ে কয়েক দফা আলোচনা চালান যে সম্পর্কিত তথ্যাবলী উনি তার “মূলধারা ‘৭১” বইতে বিস্তারিত বর্ননা করেছেন। তাই চাইতে ভাল নিশ্চয়ই কেউ জানবে না।


অক্টোবর মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়ে ১৯ দিনের সফরে পশ্চীম ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমনে যান। সে যাত্রার প্রাক্কালে দিল্লীতে তার সাথে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল সাক্ষাত করেন। সে সাক্ষাতকারকালে ইন্দিরা প্রথমবারের মত বাংলাদেশী নেতাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি অংশগ্রহনের ব্যাপারে ইংগিত দেন। যদিও তার এই মনোভাব তখনো ছিল অত্যন্ত গোপনীয়, এমনকি তার সরকারের মন্ত্রী পরিষদের অনেক সিনিয়র সদস্যও জানতেন না। ইন্দিরাও বাংলাদেশী নেতাদের অনুরোধ করেছিলেন এই সংবাদ গোপন রাখতে। কিন্তু এই সুসংবাদে উতফুল্ল সৈয়দ নজরুল আবেগ চেপে রাখতে পারেননি, তিনি কলকাতা ফিরে সবাইকে এই উজ্জীবিত আনন্দময় সংবাদ দিয়েছেন। এর ফলে ইন্দিরা তার নিজ সরকারের কাছেই হয়েছেন বিব্রত।


এরপর ১৬ই নভেম্বর ইন্দিরা তার সেই ভ্রমনের ফলাফল বাংলাদেশী নেতৃত্বকে অবহিত করতে দিল্লীতে আমন্ত্রন জানান। সম্ভবত পূর্ব অভিজ্ঞতার কারনে ইন্দিরা এবার আর চূড়ান্ত অভিযান বিষয়ে কোন কথা বলেননি। উলটো তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে তাজউদ্দিনকে জানান যে গত দুমাস যাবত তার ও ডিপি ধরের ভেতর মৈত্রীচুক্তি বিষয়ক যে আলোচনা চলছিল তা ভারত সরকার স্থগিত রাখার পক্ষপাতি; কেননা তাদের মতে ভারতে অবস্থানকালে এ ধরনের চুক্তি ভারতের চাপের ফলেই করানো হয়েছে এভাবে চিত্রিত হওয়া স্বাভাবিক। তবে এর ফলে বাংলাদেশকে মুক্ত করার ব্যাপারে ভারতের সর্বাত্মক সহায়তার কোন তারতম্য ঘটবে না এ প্রতিশ্রুতিও পূনরায় দেওয়া হয়। তাজউদ্দিন এই যুক্তি মেনে নেন, কারন বোঝা যাচ্ছিল যে ভারত নিজ থেকেই যুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহী। কাজেই, ভারতের অনাগ্রহের কারনেই সেই মৈত্রীচুক্তি আর লিখিত আকারে বাস্তবায়িত হয়নি। কথা হল যে যা আদৌ স্বাক্ষর হয়নি তা নিয়ে গুজব কিভাবে বের হল?


এই গুজবের একটি সম্ভাব্য উতস সম্ভবত টাইমস এর রিপোর্টার হেজেলহার্ষ্ট যিনি একমাত্র বিদেশী সাংবাদিক হিসেবে এই গোপনীয় আলোচনার খবর জানতে পেরেছিলেন। The Times, November 17, ’71 সংখ্যায় তিনি লেখেন; “ Mr. Tajuddin Ahmed, the prime minister of Bangladesh , had arrived in Delhi to meet senior Indian officials. It is understood that Mr. Ahmed and Indian authorities are working out the details of an Indo-Bangladesh friendship treaty which will incorporate clauses relating to a defence pact. It is believed that if Delhi is forced into a war the defence clauses could be invoked by the Bengalis to invite Indian forces into Bangladesh. At that time, the treaty would justify India’s decision to meet the Bengali’s demand: for arms and military assistance. [১]” এই আলোচনা যে শেষ পর্যন্ত আর চুক্তি পর্যন্ত পৌছাতে পারেনি তা আর এই সাংবাদিক জানতে পারেননি। কিন্তু তার এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই সম্ভবত গোপন চুক্তির গুজব ছড়ায়। 


এখন খেয়াল করে দেখুন যে ৭ দফা গোপন চুক্তির দাবীতে চুক্তি সম্পাদনের কোন তারিখ না থাকলেও মাস আছে অক্টোবর। অথছ টাইমস এর সংবাদ অনুযায়ী নভেম্বর মাসে তাজউদ্দিন দিল্লী এসেছিলেন প্রতিরক্ষা ভিত্তিক কোন একটি চুক্তি সম্পাদনার জন্য যা মঈদুল হাসানের ভাষ্যেও প্রমান হয়। অক্টোবর মাসে তাহলে কেমন করে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছিল?


এই ব্যাপারে ইন্দিরার আরেক সিনিয়র এডভাইজার পিএন হাকসার ’৮২ সালে বলেছেন, “ I opposed signing of the proposed treaty on the ground that India would have to send in forces within Bangladesh of called upon by the latter, and also this would have compromised India’s diplomatic posture of being the most moderate element in the strife [১]” ইন্দিরার ওপর সে সময় পিএন হাকসারের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রবল। বলা হয় যে সৈয়দ নজরুল সাহেব নাকি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ভারতের পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন কে? দুই দেশের মধ্যকার যে কোন চুক্তিই স্বাক্ষর হয় একই পদের কর্মকর্তা দিয়ে, এটাই কূটনৈতিক নিয়ম। যেমন কোন দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে অন্য দেশের মন্ত্রী স্বাক্ষর করে না। স্বাভাবিক নিয়মে এই চুক্তি স্বাক্ষর হবার কথা ইন্দিরার সাথে তাজউদ্দিনের। রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের সম পর্যায়ের কোন ভারতীয় স্বাক্ষর করেছিল?


তবে অফিশিয়াল কোন চুক্তি স্বাক্ষর না হলেও ভারত সম্ভাব্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সে সম্পর্কিত নানান আলোচনার জন্য ভারতের পক্ষে ডিপি ধর এবং বাংলাদেশের পক্ষে মঈদুল হাসানের মধ্যে এর পরেও মোট চার দফা বৈঠক হয়। এতে যুক্ত বাহিনী গঠনের রূপরেখা, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি সম্ভাব্য রাজনৈতিক ইস্যু, মুক্তিযুদ্ধে ব্যাবহৃত বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারের বিরাট চ্যালেঞ্জ, ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশে অবস্থানের সম্ভাব্য সময় সীমা, মার্কিন সপ্তম নৌবহরের সম্ভাব্য আগ্রাসন ও তার পটভূমি এসব আলোচিত হয়। বাংলাদেশের প্রাশাসনিক ব্যাবস্থা সেসময় অত্যন্ত দূর্বল এবং নিয়মিত সেনাবাহিনী বলতে গেলে একেবারেই অপ্রতুল প্রতীয়মান হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েই বহুদলীয় কমান্ড ব্যাবস্থার সমন্বয়ে একটি জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠন ও পরবর্তি পরিস্থিতি অনুযায়ী তাদের ব্যাবহারের কথাও আলোচিত হয়। তবে গোপন চুক্তির বয়ান অনুসারে সেনাবাহিনী থাকবে না এমন কোন কথা আলোচিত হয়নি, স্বাধীনতা পরবর্তি আমলেও এমন কোন আলামত দেখা যায়নি। 


গোপন চুক্তি ফাঁসকারীদের দাবী পড়লে মনে হয় যে মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতীয় সৈন্যদের কোনভাবেই বাংলাদেশ থেকে তাড়ানো যাচ্ছিল না, পাকিস্তানী সৈন্যদের বদলে তারাই জেঁকে বসেছিল, বংগবন্ধু এক ধমকে তাদের না তাড়ালে আজীবন তারা এ দেশেই থেকে যেত। বাস্তব সত্য হল বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনী অবস্থান সম্পর্কে ভারতীয়দের নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল সম্ভাব্য সবচেয়ে কম সময় অবস্থান করা। এ কথা ডিপি ধর সরাসরি ব্যাক্ত করেন নভেম্বরের সমঝোতা বৈঠকেই, কারন ভারতীয় মতে এভাবেই কেবল সুপ্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সুনাম অক্ষুন্ন থাকতে পারে। বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী অবস্থান যে দেশে বিদেশে নানান প্রশ্ন ও কূটনৈতিক সমস্যার জন্ম দেবে তা ভারত সরকার ভালই জানত। এ সম্পর্কে ও চুক্তির আরো কিছু পয়েন্ট বিস্তারিত আকারে পরের পর্বে থাকবে।


তবে এটা ঠিক যে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ওসমানী যৌথ কমান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত ব্যাক্তিগতভাবে মেনে নিতে পারেননি। তিনি এমনকি এ কারনে পদত্যাগের হুমকিও দিয়েছিলেন। তার পদত্যাগের ঘটনা আগেও একবার ঘটেছিল জিয়া কর্তৃক তার দক্ষতা নিয়ে গুরুতর আপত্তির কারনে। সে সময় তাজউদ্দিন বহু কষ্টে তার পদত্যাগ বাতিল করান। যৌথ বাহিনী গঠন সম্পর্কে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় নভেম্বরের ২০ তারিখ, অক্টোবর মাসে নয়। ওসমানীর এই মনোভাবকে পুঁজি করে পরবর্তিকালে ১৬ই ডিসেম্বরের আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে তাকে ভারতীয়রা যেতে দেয়নি এ ধরনের কল্পকাহিনীও ফাঁদা হয়েছে, যার সঠিক ব্যাখ্যা বহুবার দেওয়া হয়েছে।




সূত্রঃ 
১। মূলধারা '৭১ - মঈদুল হাসান।
২। ৭১ এর দশমাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী।
৩। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ -

        ( COLLECTED )